দেশে বিদ্যুতের বর্তমান ইনস্টল ক্যাপাসিটি ২৪ হাজার ২৬৩ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ বাদে)। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) হিসাব অনুযায়ী, আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ সক্ষমতায় যুক্ত হবে আরো অন্তত সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। এ সক্ষমতা যুক্ত হলে দেশে সংশ্লিষ্ট সময়ে মোট সক্ষমতা তৈরি হবে ৩৮ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। অথচ দেশে বর্তমানে (জুলাই ২০২৩) বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে গড়ে সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। চলতি বছর বাদ দিয়ে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে প্রতি বছরে ১০ শতাংশ হারে অর্থাৎ বছরে ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট করে চাহিদা বৃদ্ধি পেলে সংশ্লিষ্ট বছরে চাহিদা দাঁড়ায় ১৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। সে হিসাবে ২০২৫ সাল নাগাদ যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হবে, তার প্রায় ৬০ শতাংশই অব্যবহৃত থাকবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বর্তমানে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে তার অর্ধেকেরই কিছু বেশি ব্যবহার হচ্ছে। বাকি সক্ষমতার কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে বিপিডিবি। সংস্থাটির বিদ্যমান আর্থিক যে পরিস্থিতি তাতেই বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের সংস্থান হচ্ছে না। অতিরিক্ত সক্ষমতার যুক্ত হলে বিপিডিবির কাঁধে যে পরিমাণ ব্যয়ের বোঝা যুক্ত হবে তা সামাল দেয়া কষ্টসাধ্য হবে।
বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিপিডিবির সক্ষমতার তালিকায় যুক্ত হবে মোট ৫ হাজার ৮৪৯ মেগাওয়াট। ২০২৪ সালে ৭ হাজার ৬৯০ মেগাওয়াট এবং ২০২৫ সালে যুক্ত হবে আরো ৯৮১ মেগাওয়াট।
চলতি বছর ধরে হিসাব করলে আগামী আড়াই বছরে বিদ্যমান সক্ষমতার সঙ্গে আরো সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। যদিও এরই মধ্যে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বেশ কয়েকটির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছে। অনেকগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র কমিশনিংয়ের অপেক্ষায়ও রয়েছে।
গত বছর প্রকাশিত জ্বালানিসংক্রান্ত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিপিডিবির যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে, তাতে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট সক্ষমতার মাত্র ৫০ শতাংশ ব্যবহার করা যাবে। তবে এ সক্ষমতা ব্যবহার করা যাবে যদি বিদ্যুতের চাহিদা ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। বিদ্যুতের সর্বনিম্ন চাহিদার বিপরীতে বেসরকারি খাতের বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ সক্ষমতা বাড়ার প্রেক্ষাপটে বিপিডিবির ক্যাপাসিটি চার্জ ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে বলে পূর্বাভাস দেয় গবেষণা সংস্থাটি।
বিপিডিবির আর্থিক ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি এরই মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে সংস্থাটি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির ঊর্ধ্বমুখী দামে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, পর্যাপ্ত সক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারা, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং কম মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয় করে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রিতে সংস্থাটির বিপুল পরিমাণ আর্থিক দায়দেনা তৈরি হয়েছে। বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে এরই মধ্যে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে। বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ বিল না পাওয়ায় এর অনেক কেন্দ্রই জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না। পায়রার মতো বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে কয়লা বাবদ বিল বকেয়া থাকায় জ্বালানি সংকটে প্রায় এক মাসের মতো উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়।
বিপিডিবির আর্থিক ঘাটতি তৈরি হওয়ায় গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সংস্থাটির কর-পরবর্তী লোকসান হয় ৩ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। শুধু ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় ওই অর্থবছরে সংস্থাটির ৬১১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা লোকসান হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি ছাড়িয়ে যাবে বলে এরই মধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ সক্ষমতা বাড়ানোর বিপরীতে তা ব্যবহার করতে না পারার আর্থিক খেসারতও উঠে এসেছে বিপিবিডির ওই প্রতিবেদনে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ব্যয় হয় ৭৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৫১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বাড়ে ২২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরে আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে সংস্থাটির ব্যয় হয় ৪৯ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক অর্থবছরের ব্যবধানে বিপিডিবির ব্যয় বাড়ে ৭৭ শতাংশ।
বিপিডিবির নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দুজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিপিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়ে আগের অনেক বিল বকেয়া রয়েছে। বর্তমানে সেগুলো নিয়েই সমাধান করার চেষ্টা চলছে। সামনে কী হবে, সেটি নিয়ে এ মুহূর্তে সংস্থাটি ভাবছে না। তবে সরকারের ভর্তুকি ছাড়া সংস্থাটি পরিচালনা করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি দ্রুত লোকসান থেকেও বেরিয়ে আসা কষ্টকর হবে।’
দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর অংশ হিসেবে এরই মধ্যে বেশকিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। বিশেষ করে কয়েকটি বৃহৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রস্তুত হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট এসএস পাওয়ার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চলতি বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। এরই মধ্যে কেন্দ্রটির একটি ইউনিট পরীক্ষামূলক বেশ কয়েকদিন উৎপাদনেও ছিল। জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে রামপাল ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। কেন্দ্রটির দুটি ইউনিট কমিশনিং হয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে সামিটের ৫৮৩ মেগাওয়াট, ইউনিক গ্রুপের ৬০০ মেগাওয়াট এবং ভারতীয় রিলায়েন্স ও জাপানের জেরার অংশীদারত্বে নির্মাণাধীন ৭৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চলতি বছরের মার্চে উৎপাদনে আসার কথা ছিল। যদিও এসব কেন্দ্র বেশ কয়েক মাস আগে প্রস্তুত হওয়ার পরও এখন গ্যাস সংযোগের কারণে উৎপাদনে যেতে পারেনি।
এছাড়া কক্সবাজারের মহেশখালীতে নির্মিত মাতারবাড়ী ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এবং দ্বিতীয় ইউনিট ওই বছরের জুলাইয়ে উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রথম ইউনিট ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার (দ্বিতীয় পর্যায়) আরেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আগামী বছরের মার্চে উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে।
বৃহৎ সক্ষমতার এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে গেলে এবং তা বসিয়ে রাখলে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, বিপিডিবির বড় ধরনের পেনাল্টি রয়েছে। তবে এসব কেন্দ্রের আর্থিক ব্যয় বিপিডিবি কীভাবে মেটাবে তা নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে বলে জানান জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিপিডিবির আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পেছনে তাদের অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত ছিল। বিদ্যুতের একক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা অনেকগুলো বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করেছে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা বা আদৌ প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা সেটি চিন্তা করেনি। এখন অনেকগুলো কেন্দ্র বসে রয়েছে গ্যাসের অভাবে। এসব কেন্দ্র বাণিজ্যিক উৎপাদন ঘোষণা হলেই বিপিডিবির ক্যাপাসিটি চার্জ শুরু হবে। বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তিতে শর্ত অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কিনতে না পারলে পেনাল্টি রয়েছে। যেটা আমরা পায়রার ক্ষেত্রে দেখেছি। বসিয়ে রেখে বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন বিপিডিবির এ পরিস্থিতির ভেতর থেকে শিগগিরই বেরিয়ে আসার পথ নেই। ক্যাপাসিটি চার্জ, অতিরিক্ত সক্ষমতা এবং উৎপাদন ব্যয়ে ভঙ্গুর দশা তৈরি হয়েছে বিপিডিবির আর্থিক কার্যক্রমে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিপিডিবি ভর্তুকি নিয়ে চলছে। তারা এরই মধ্যে সংকটের মধ্যেই রয়েছে। একটি কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠান হিসেবে যদি বিপিডিবিকে চিন্তা করি, তাহলে তাদের একটা পরিকল্পনা থাকা দরকার ছিল। তাহলে এ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো না। সংস্থাটির যারা নীতিনির্ধারক রয়েছেন তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। তাদের ওপর এক ধরনের চাপ রয়েছে। যে কারণে আজকে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে বিপিডিবির আর্থিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে করেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র অবসর, বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তিতে নবায়ন এবং নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যয় কমাতে মেয়াদ শেষ হতে যাওয়া বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে নতুন করে ক্রয় চুক্তিতে না যাওয়ার কথা ভাবছে সরকার। আবার বিদ্যুৎ ক্রয়ের নতুন চুক্তিগুলো করা হচ্ছে “নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট” ভিত্তিতে। ফলে এখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ আর থাকছে না। এক্ষেত্রে খরচ কমে আসছে। পাশাপাশি বিদ্যুতের সিস্টেম লস, কার্যকারিতা কম এমন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়াসহ নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো হচ্ছে।’
( বণিক বার্তা )
পাঠকের মতামত